শ্রীশ্রীমৎ ১০৮ স্বামী দয়ানন্দ অবধূতের সংক্ষিপ্ত জীবনি আলোচনাঃ

Abadhut Sangha
By -
0

 

 

 
জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
১২৯১ বঙ্গাব্দের ৩০ কার্তিক কৃষ্ণাত্রয়োদশী তিথিতে বর্তমান বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলায় সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম হয় মহাযোগী শ্রী শ্রীমৎ ১০৮ স্বামী দয়ানন্দ অবধূতের।শ্রী শ্রী গুরুদেবের জ্যাঠা উকিল হওয়ায় উকিলবাড়ি বলেই বাড়িটি প্রসিদ্ধ ছিল।ঠাকুরের বাল্যকালের নাম গোপাল।এই গোপাল নাম গুরুদেবের মাতুল হেমচন্দ্রের দেয়া।পিতৃপ্রদত্ত নাম রাজেন্দ্রমোহন চক্রবর্তী।সন্ন্যাসী হবার পর নাম শ্রী শ্রীমৎ ১০৮ স্বামী দয়ানন্দ অবধূত।
পিতা চন্দ্রমোহন চক্রবর্তী পেশায় কালেক্টার অফিসের পেশকার ছিলেন ও পারিবারিক তালুকদারি দেখাশোনা করতেন।
মাতার নাম সুনীতি চক্রবর্তী।সুনীতি দেবী গৃহীনি ও অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও পরিব্রতা সতীলক্ষ্মী নারী ছিলেন।
সংসার জীবনঃ
যৌবনে পদার্পনের সাথে সাথে শ্রী শ্রী গুরুদেবের বিবাহ সম্পন্ন হয়।শ্রী শ্রী গুরুদেবের প্রথমা পত্নীর নাম জানা না গেলেও ওই তার একটি মাত্র পুত্র ছিল তার নাম রবীন্দ্রমোহন চক্রবর্তী।সিদ্ধিলাভের পর গুরু আদেশে কৃষ্ণানন্দ অবধূত(পিতৃপ্রদত্ত নাম কমলা) কে বিবাহ করলেও সংসার ধর্ম পালন করেন নি।
শিক্ষাঃ
বরিশাল ব্রজমোহন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেনির ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করে নবম শ্রেনি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন।লেখাপড়া বন্ধের পেছনে দুরন্তিপনা ও গনিত ভীতিই দায়ী ছিল।
পেশাঃ বরিশাল সেটেলমেন্ট অফিসে চাকুরি এবং পরে পিতার তালুকদারি দেখাশোনা।তারপরে সাধন জীবনে প্রবেশ।
সাধনার জীবনঃ
প্রথমা স্ত্রীর সন্তান জন্মদানের পর অকাল মৃত্যুতে সংসারের প্রতি তীব্র বৈরাগ্য অনুভব করে কুলগুরু চন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য এর পরামর্শে ও একজন উত্তর সাধকের সাহায্যে এক ভাদ্র মাসের আমাবস্যাতে ৩নং শক্তিপীঠ সুগন্ধার উগ্রতাঁরা মন্দিরে কঠোর সাধনায় জগন্মাতার নির্দেশ আসে আসামে কামাখ্যায় যোনী পীঠে সাধনার।কিন্তু সেখানে যাবার আগে কিছু তান্ত্রিক ও হঠযোগ সাধনার বাসনা জাগে রাজেন্দ্রমোহন এর।এজন্য যোগীগুরু" শ্রীমৎ উদাসীন গোস্বামী " এর নিকট উপস্থিত।এক সময় গোস্বামীজি কাশ্মির চলে যান।রাজেন্দ্রমোহন তার খোঁজে সেখানে যান।কিছু কাল যোগাভ্যাস করে।গোস্বামীজীর নির্দেশে ফিরে আসতে যান।তখন পথিমধ্যে নরখাদক ও বন্য প্রানীর খপ্পরে কয়েকবার পরলেও জগন্মাতা উদ্ধার করে।এর পর সে হঠযোগী সাধু বাবার সন্ধান পান।ওই সাধু তাকে খেচরিমুদ্রন যোগ শিক্ষা দেন যা দ্বারা নিজের ইচ্ছাধীন আহার না করে থাকতে পারেন।এরপর কাশিতে এসে সাক্ষাৎ পায় তাঁর জ্ঞানীগুরু রামেশ্বরানন্দ গুরুজীর। যিনি রাজেন্দ্রমোহনকে সাধনা ও সিদ্ধিলাভের রাস্তা দেখান।এরপর বরিশাল উজিরপুরের নিজ বাড়িতে চলে আসেন সাধক রাজেন্দ্রমোহন। গর্ভধারিণী ও কুলগুরুর আশীর্বাদ নিয়ে কামাখ্যায় সাধনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।এক আমাবস্যায় কঠোর সাধনায় সেখানে রত থাকা অবস্থায় জগন্মাতার আদেশ আসে গর্ভধারিণীর পূর্ন অনুমতি নিয়ে সুগন্ধা শক্তিপীঠের ভৈরব পীঠ ঝালকাঠির পোনাবালিয়া শিব বাড়িতে সাধনা করার কারন তার মাতৃসাধনা তার সম্পন্ন হয়েছে।এর পর রাজেন্দ্রমোহন নিজ বাড়িতে এসে গর্ভধারিণী আশীর্বাদ নিয়ে পোনাবালিয়া শিব বাড়িতে সাধনা করতে যায়।
সিদ্ধিলাভঃ শিববাড়িতে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মন্দিরের ভিতর সাধনা শুরু করে।একটানা ১৫ দিন বাহ্যজ্ঞানশুন্য অবস্থায় সাধনা করার পর বাংলা ১৩২০ সালের মাঘ মাসের মাঘী সপ্তমী তিথিতে পূর্ন সিদ্ধিলাভ ঘটে সাধকের।খেচরিমুদ্রন এ পারদর্শী হওয়াতে এতদিন না খেয়ে থাকাতে কোনো সমস্যাই হয়নি।সিদ্ধিলাভের সময় সদাশিব প্রথমে এক বৃদ্ধের রূপে লাঠি হস্তে দেখা দেয়।এর আগে ভগবান শংকর তাঁর চর নন্দীকে দিয়ে সাধকে পরীক্ষা করেন কিন্তু সাধক উত্তীর্ন হয়।এই প্রথম রূপটি হয়ত অনেকটা তার জ্ঞানীগুরু রামেশ্বরানন্দ জীর সদৃশ ছিল।সাধকের অনুরোধে সদাশিব কৈলাসে ধ্যানমগ্ন রূও প্রদর্শন করায়।এর পর ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও রুদ্র এই ত্রিমূর্তি রূপ দর্শন করেন সাধক।এর জগন্মাতা মহালক্ষ্মী বা পার্বতির রূপ প্রত্যক্ষ করে সাধক।এর পর গুরুভক্তি বর লাভ করে সদাশিব শংকরের নিকট হতে এবং শিবত্বপ্রাপ্তি ঘটে সাধকের।তখন সাধক এর দেহ আর শিবে আর কোনো পার্থক্য নেই।সদাশিব তার সকল রূপ নিয়ে চলে যান এবং সাধককে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যখন সাধক চাইবে তখনই তারা প্রকট হবে।এই শিববাড়ি এখন অবধূত সংঘের শিষ্যদের নিকট অবধূত সিদ্ধপীঠ নামেই সমাদৃত।
সাধনা উত্তর জীবনঃ
সিদ্ধিলাভের পর সাধক চলে যায় গর্ভধারিণী মায়ের কাছে।সেখানে উপস্থিত হয় বসন্ত চক্রবর্তী।যিনি শিববাড়ির পুরোহিত। দীক্ষা প্রার্থনা করে সাধকের নিকট।প্রথমে রাজী না হলেও পরে দীক্ষা দেন।এই থেকে শুরু হয় গুরু হিসেবে চলার ও ধর্মপ্রচার এর পালা।
ধর্মপ্রচারঃ ঝালকাঠি, উজিরপুর,গুঠিয়া, বানরীপাড়া,গৈলা,কাউনিয়া সহ বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চল,ফরিদপুর,কোলকাতা,কাশি, পুরী,নৈহাটি সহ বিভিন্ন জায়গায় গমন করে ধর্মপ্রচার শুরু হয়।যেখানেই তিনি যেতেন সেটিই আশ্রমে পরিনত হত।এরই মধ্যে যোগীগুরু রামেশ্বরানন্দ আদেশ করলেন অবধূত সন্ন্যাস নেবার জন্য।কিন্তু এর জন্য পত্নীর প্রয়োজন।তখন গুরুজী বললেন,"তোমার প্রথমা পত্নীকে খুজে নাও"।সাধক রাজেন্দ্রমোহন যোগবলে জানলেন কোথায় জন্ম নিয়েছেন তার প্রথমা পত্নী।সেখানে গিয়ে পুনরায় বিবাহ করেন কিন্তু সংসারধর্ম পালন আর করেন না।কমলা দেবী জাতিস্মর ছিলেন।তিনিও রাজেন্দ্রমোহন ছাড়া কাউকে বিবাহ করবেন না মনস্থির করেছিলেন।তারপর দুজনেই সন্ন্যাস গ্রহন করেন।রাজেন্দ্রমোহন এর নাম হয় দয়ানন্দ অবধূত ও কমলাদেবীর নাম হয় কৃষ্ণানন্দ অবধূত।এর পর দয়নন্দ ঠাকুরের নির্দেশে মাতাজি হাজারিবাগ এ অবধূত আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই থেকে যান।অবধূত সংঘ প্রতিষ্ঠা ও গুরুনাম প্রচার চলতে থাকেম।"গুরু ব্রহ্মা গুরু শ্যাম গুরু শিব গুরু রাম" এই নাম প্রচার করেন স্বামী দয়ানন্দ অবধূত।গুরুপূর্নিমা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অবধূত সংঘের অনুষ্ঠান শুরু হয়।গুরুপূর্নিমা ছাড়া অক্ষয় তৃতীয়া ও গুরুদেবের জন্ম উৎসব করা হত।জন্মোৎসব এর সময় দুর্গাপূজার মত ছুটি নিয়ে শিষ্যরা আসত যেখানে শ্রী শ্রী ঠাকুর অবস্থান করতেন।দয়ানন্দ ঠাকুর ধর্মপ্রচার করতে থাকেন বিভিন্ন জায়গায়।তবে বেশিরভাগ থাকতেন পোনাবালিয়া,গুঠিয়া,বেতাগি,মোকামিয়া, শ্রীরামকাঠি এসব জায়গায়।আবার পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ও কাশিতে যেতেন।বসন্ত চক্রবর্তীর বোন লক্ষ্মী সতীদাহপ্রথার বলি হতে গেলে তাকে উদ্ধার করে যথাসময়ে দীক্ষা দেয় দয়ানন্দ ঠাকুর।সেই গুরুনাম বলে সিদ্ধিলাভ করে সাক্ষাৎ জগন্মাতার রূপ প্রাপ্ত হয় লক্ষ্মী মাতাজি।
অন্তিম জীবনঃ
জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটান গুঠিয়ার বালাবাড়িতে।গুঠিয়া বালাবাড়ি থেকে খুব একটা বেশি আর পরে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতেন না।সেখানে সেবা করার জন্য ও তাঁর অবর্তমানে গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য পোনাবালিয়া থেকে গুঠিয়াতে নিয়ে আসেন লক্ষ্মী মাতাজিকে।বসন্ত চক্রবর্তীর ছোট ছেলে অমলানন্দের জন্মের ২১ দিনের দিন তাঁকে গিয়ে বন্ধন করেন এবং গুরুদেব দেহত্যাগের ৬ মাস পূর্বে গুঠিয়াতে নিয়ে আসেন তাঁকেও।লক্ষ্মী মাতাজিকে বলেন বসন্তের ছোট ছেলেটিকে আমার ভার ধারনের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।অমলানন্দকে দীক্ষা দিয়ে শিষ্য করে নেন দয়ানন্দ অবধূত ঠাকুর। ১৩৬১ বঙ্গাব্দের ৬ ই আশ্বিন সন্ধ্যা ৬ টা ৩০ মিনিটে অমলানন্দেরর কোলে মাথা রেখে দেহত্যাগ করেন স্বামী দয়ানন্দ অবধূত। দেহত্যাগের পূর্বে তার সকল সম্পদ ও আশ্রম কোনটি কিভাবে কার দ্বারা নিয়ন্ত্রন হবে তার নির্দেশ দিয়ে যান লক্ষ্মীমাতার নিকট।শ্রী শ্রী গুরুদবের দেহ তাঁর পুত্র উজিরপুর বাড়িতে নিয়ে যান ও দেহ সৎকার সম্পন্ন করেন।
দেহ ত্যাগ উত্তর ঘটনাঃ লক্ষ্মীমাতাজিকে দেয়া সেই নির্দেশে হাজারিবাগ আশ্রম এর ভার কৃষ্ণানন্দ মাতাজি,কাশির আশ্রম শান্তমায়ের কন্যা বিনোদিনী দেবির,পুরীর আশ্রম গুরুদেবের কাকাত ভাই হরেন্দ্রমোহন চক্রবর্তীর উপর আর কোলকাতার সম্পদগুলো দিয়ে সেখানকার শিষ্যদের আড়িয়াদহে অবধূত আশ্রম তৈরী করার নির্দেশ করেন।পূর্ব পাকিস্তানের শিষ্যদের লক্ষ্মী মাতাজির মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।১৯৬৪ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষ্মীমাতার দেহ ত্যাগের পর অমলেন্দু সেই ভার গ্রহন করে।অমলানন্দ অবধূত নামে প্রসিদ্ধ হন।১৯৭৩ সালে কৃষ্ণানন্দ মাতাজির দেহ ত্যাগ করার পর সংঘের একমাত্র কর্নধার হন স্বামী অমলানন্দ অবধূত।যাকে দয়ানন্দ অবধূতের প্রতিচ্ছবি বলে ধরা হয়।
তথ্যসূত্রঃ স্বামী দয়ানন্দ অবধূতের জীবনকথা( ১ম,২য় ও ৩য় খন্ড) ও স্বামী দয়ানন্দ অবধূতের জীবনচরতি।
পুনঃ লেখনী ও তথ্য সংগ্রহ : সৌরভ গাঙ্গুলী

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)